ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার সাম্প্রতিক পদক্ষেপ ও বিবৃতিগুলোর তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে পশ্চিমারা। নিন্দা ছাড়াও ঘোষণা করেছে অবরোধ। সবার মনে এখন প্রশ্ন এর পর কী? এই সংঘাত কি আরো বড় যুদ্ধের দিকে যাবে?
পর্যবেক্ষকরা মনে করেন রাশিয়া-ইউক্রেন সীমান্তে পরিস্থিতি এই মুহূর্তে যত খারাপই হোক, মার্কিন নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটোর সঙ্গে রাশিয়ার সরাসরি সামরিক সংঘাতের অবকাশ নেই। বস্তুত মস্কোর সামরিক উপস্থিতি বাড়িয়ে ইউক্রেন আক্রমণে সক্ষম বাহিনী মোতায়েনের বিপরীতে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তাদের ছোট পরিসরের সামরিক প্রশিক্ষক ও উপদেষ্টাদের সেখান থেকে দ্রুত প্রত্যাহার করে নিয়েছিল।
চলতি মাসের গোড়ার দিকে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছিলেন, ‘রাশিয়া ও আমেরিকা একে অপরের দিকে গুলি ছুড়লে সেটা হবে বিশ্বযুদ্ধ। ’ তবে তিনি জানান, কোনো অবস্থাতেই ইউক্রেনে মার্কিন সেনা মোতায়েন হবে না।
পশ্চিমা নেতারা এখনো রাশিয়ার ইউক্রেনে পূর্ণ মাত্রার যুদ্ধের আশঙ্কা করছেন। মূলত কোনো একজন মানুষের পরিচয়, তার অবস্থান কোথায় এবং রাশিয়ার পরবর্তী পদক্ষেপের ওপর নির্ভর করছে কতটা উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত।
ইউক্রেনের সম্মুখসারির যোদ্ধাদের জন্য পরিস্থিতি অবশ্যই বিপজ্জনক। সংকটটি দৈনন্দিন জীবনে কতটা প্রভাব ফেলে তা নিয়ে লাখো ইউক্রেনবাসীর উদ্বেগ বিদ্যমান। একমাত্র পুতিন ও তার চারপাশের বিশ্বস্ত লোকই জানে তিনি ইউক্রেনের কতটা ভেতরে সেনা পাঠাবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত রাশিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণের জন্য সেনা সমাবেশ বহাল থাকবে ততক্ষণ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভ ও অন্য শহরগুলো আক্রমণ থেকে নিরাপদ থাকবে না।
কিন্তু ন্যাটো ও পশ্চিমাদের জন্য লাল রেখা হচ্ছে, যখন রাশিয়া ন্যাটোভুক্ত কোন রাষ্ট্রকে সরাসরি হুমকি দেবে। ন্যাটো কার্যপদ্ধতির অনুচ্ছেদ-৫ অনুযায়ী, কোনো সদস্য রাষ্ট্র সামরিক আক্রমণের মুখে পড়লে সমগ্র পশ্চিমা সামরিক বাহিনী নিজেদের রক্ষা করবে। ইউক্রেন ন্যাটোর সদস্য নয়। যদিও তারা জোটে যোগ দিতে চায় এবং পুতিন তা রুখতে চান।
পূর্ব ইউরোপের দেশ পোল্যান্ড অথবা বাল্টিক রাষ্ট্র এস্তোনিয়া, লিথুনিয়া ও লাটভিয়া সোভিয়েত জামানায় মস্কোর অনুগামী ছিল। তারা এখন ন্যাটোর সদস্য। এসব দেশ আশঙ্কা করছে, রাশিয়ার বাহিনী ইউক্রেনে না-ও থামতে পারে। পরিবর্তে মস্কো বাল্টিক অঞ্চলের জাতিগত রুশ জনগোষ্ঠীকে ‘সাহায্য করতে’ পারে এবং আক্রমণের অজুহাত তৈরি করতে পারে।
সে কারণে ন্যাটো পূর্ব ইউরোপের সদস্যদের সমর্থনে প্রতিরোধব্যুহ তৈরি করতে সেখানে শক্তি বৃদ্ধি করেছে। রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে সরাসরি সংঘাত না হওয়া পর্যন্ত ইউক্রেন সংকট বিশ্বযুদ্ধ তৈরির মতো নেতিবাচক পরিস্থিতি তৈরি করবে না।
সেইসঙ্গে ভুলে গেলে চলবে না রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের কাছে ৮ হাজারেরও বেশি মোতায়েনযোগ্য পরমাণু যুদ্ধাস্ত্র রয়েছে। সে অস্ত্রের প্রয়োগ সবার জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। তাই বড় পরিসরে আক্রমণ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। স্নায়ুযুদ্ধকালে মস্কো ও ওয়াশিংটনের মধ্যে সমঝোতার ভিত্তিতে পরমাণু অস্ত্র প্রয়োগের ক্ষেত্রে উভয়পক্ষের ধ্বংসের নিশ্চয়তা (মিউচুয়ালি অ্যাসিউরড ডেস্ট্রাকশন-ম্যাড) বিষয়ক সমঝোতা এখনো কার্যকর।
গত মঙ্গলবার ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর একটি সূত্র বলে, পুতিন ন্যাটো অঞ্চল আক্রমণ করতে যাচ্ছেন না। তিনি শুধু ইউক্রেনকে বেলারুশের মতো একটি তাঁবেদার রাষ্ট্রে পরিণত করতে চাচ্ছেন।
এখানে অনিশ্চিত বিষয়টি হচ্ছে পুতিনের মন। খুব হিসাবী লোক হিসেবে পরিচিত হলেও সোমবারের ভাষণের সময় তাকে ধুরন্ধর কুশলীর চেয়ে ক্রুদ্ধ একনায়কই মনে হয়েছে বেশি। ন্যাটোকে তিনি ‘অশুভ’ আখ্যায়িত করেছেন। ইউক্রেনকে কার্যত বলেছেন তাদের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিদ্যমান থাকার অধিকার নেই। এই বিষয়টা উদ্বেগজনক।
রাশিয়া পশ্চিমাদের অবরোধের কোন না কোনভাবে পাল্টা ব্যবস্থা নেবে। রাশিয়াতে পশ্চিমা ব্যবসাবাণিজ্যের ওপর প্রভাব পড়বে। তবে পুতিন চাইলে বিষয়টা আরো অনেক দূর গড়াতে পারে। রাশিয়ার প্রতিশোধ সাইবার হামলার রূপেও আসতে পারে। ন্যাশনাল সাইবার সিকিউরিটি সেন্টার ইতিমধ্যেই এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়েছে। সাইবার হামলার ক্ষেত্রে আক্রমণটা কে করল তা অনেক সময় ধরাও যায় না। এর মাধ্যমে ব্যাংক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তি এমনকী গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় অবকাঠামোকে লক্ষ্যবস্তু করা হতে পারে।
সমস্যা হচ্ছে মস্কোর সঙ্গে বছরের পর বছরের অবনতিশীল সম্পর্কের পর রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস এখন তলানিতে ঠেকেছে। এমন প্রেক্ষাপটেই প্রকাশ্যে চলে আসতে পারে চলমান সংকটের জন্য দায়ী কে সে অপ্রীতিকর বিতর্কটি।
0 Comments